আগে যদি কাউকে প্রশ্ন করা হত তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? তখন উত্তর আসতো আমি বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ভাল একজন শিক্ষক হতে চাই।
বর্তমান সময়ে বিশেষ করে ছেলেদের প্রশ্ন করা হলে তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?
এখন উত্তর আসে বড় হয়ে আমি প্রবাসী হতে চাই বা বিদেশ যেতে চাই?
এর পিছনে যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে, বিশেষ করে পুরো বাংলাদেশ ও আমাদের বালুচর ইউনিয়ন তথা মুন্সী-গঞ্জ এর প্রতিটি ঘরে ঘরে একাধিক লোক প্রবাসে আছে। যারা কঠোর পরিশ্রম করে তাদের পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখছে।আজ প্রবাসী বাবা, ছেলে, অন্যান্য আত্মীয়দের কারণে পরিবারের লোকজন তেমন আর্থিক অভাব-বোধ করেনা। প্রবাসীদের কল্যাণে অনেক পরিবারেই সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজে তাদের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে।
এক সময় যারা দিন এনে দিন খেত তারা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বাড়ি, গাড়ি করে আগের অবস্থান থেকে উন্নতি লাভ করেছে। এর মূল অবদান হচ্ছে প্রবাসীদের কষ্টে অর্জিত টাকা।তাই আমাদের সমাজে এখন কঠিন প্রতিযোগিতা চলছে প্রবাসী হওয়ার জন্যে। পাশের বাড়ির একজন প্রবাসে গিয়ে বাড়িতে বিল্ডিং তুলেছে। এখন আমাকেও প্রবাসে গিয়ে টাকা উপার্জন করে বাড়িতে বিল্ডিং দিতে হবে। আমার বন্ধু আন্ডার মেট্রিক, প্রবাসে গিয়ে বউকে পাঁচ ভরি স্বর্ণালংকার কিনি দিয়েছে, আমার বউয়ের বায়না আমাকেও স্বর্ণালংকার কিনে দিতে হবে। কিন্তু আমি চাকরি করে বিশ হাজার টাকা বেতনে পাই। এই টাকা দিয়ে আমি সংসার চালাব নাকি গয়না কিননে দিব? শুরু হয় সংসারে অশান্তি। এই হল আমাদের সমাজের চরম বাস্তবতা। যখন আমরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং অন্যদের সাথে নিজেদের তুলনা করতে যাই তখনই আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সুখে থাকতে পারিনা। তখনই শুরু হয় প্রবাসে যাওয়ার প্রতিযোগিতা।
ছোটকাল থেকেই ছেলে মেয়েরা পরিবারের কর্তাকে প্রবাসে দেখে বড় হতে থাকে। তারা দেখে তাদের বাবা, চাচা, মামা, খালু, বড় ভাই সহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন বিদেশ গিয়ে জীবিকা উপার্জন করছে। তাই পরিবারের ছেলে সদস্যদের মেন্টালিটি ছোট কাল থেকেই তৈরি হয় বাবার মত, ভাইয়ের মত আমিও বিদেশ যাব। অনেক অভিভাবক চিন্তা করেন পড়া লেখা করে কি হবে? বিদেশ গেলে টাকা কামাইবে, তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তাই ছেলে একটু হাতে পায়ে বড় হতে দেরি, বিদেশ পাঠাইতে দেরি হয়না। অথচ এই ছেলেটি ঠিকমত পড়াশুনা করার সুযোগ পেলে দেশেই ভাল কিছু করতে পাড়তো। এখানে তার সুপ্ত প্রতিভাকে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হল।
যাই হোক, ১৭ থেকে আঠার বছর ছেলের কাঁধে ৬ থেকে ৭ লক্ষ টাকার বুঝা কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হল। বিদেশ এসেই প্রথমে এক বড় ধরনের ধাক্কা খায় বিদেশের পরিবেশ, সংস্কৃতি, ও নিয়ম নীতির উপর।এখানে এসে বিভিন্ন জাতির লোকর সাথে মিশতে হয়, কাজ করতে হয়। এদের ভাষা, সংস্কৃতি ভিন্ন যার সাথে সে আগে কখনই পরিচিত না।তারপর শুরু হয় জীবন যুদ্ধ, শারীরিক অবস্থা, কাজের পরিবেশ, কাজের ধরন যা সে আগে কখনও করেনি। এখন কাজ করতে গিয়ে পড়তে হয় বিভিন্ন অসুবিধায়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যেহেতু বিদেশ সেহেতু আমাদের অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানকে যে কোন বিষয়ের উপর কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশ পাঠানো। যাতে করে বিদেশ গিয়ে সে একটা নির্দিষ্ট কিছু করে জীবিকা অর্জন করতে পারে।
এই বাস্তব সম্মত জ্ঞানের এবং অভিজ্ঞাতার কারণেই প্রথমে এসে পড়তে হয় বিপদে। বিদেশ আসার পর না পারে ভাল কিছু করতে, না পারে দেশে চলে যেতে। ৬ লক্ষ টাকা সুদের উপর নিয়ে বিদেশে সুখ কিনতে এসে দু:খ, অশান্তি, আর মানসিক টেনশন নিয়ে বছরের পর বছর প্রবাসে কাটিয়ে দিতে হচ্ছে। একটা সময় এসে ঋণ পরিশোধ হলেও প্রবাস জীবন থেকে জীবনের মুক্তি মেলেনা। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সুন্দর, সুখের সময়গুলো বিসর্জন দিতে হয়, প্রবাসে বসে। সংসার আর ইহ জীবন থেকে মুক্তি মিললেও প্রবাস জীবন থেকে মুক্তি মিলেনা অনেকের।আমাদের অনেকই এই চিন্তা করে থাকি, সংসারে একটু আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে আসলেই দেশে এসে ভালো কিছু করবে। কিন্তু এটা অনেকের ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেনা। ১০ থেকে ২০ বছর বিদেশ করেও তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারেনা। আমার বাস্তব অভিজ্ঞাতা থেকে বলতেছি, এমন অনেককে দেখেছি ১০ বছর বিদেশ করে দেশে এসে আগে যে পেশায় কাজ করেছে, এখনও সেই পেশায় কাজ করছে। কারণ দেশে আসার পর তার অন্য কোন কাজ জানা নেই। ব্যবসা করবে ঐ মূলধনও নিয়ে আসতে পারেনি। তাই আমাদের অভিভাবকদের এখনই ভেবে দেখা উচিত।আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিদেশ-মুখী থেকে মুখ করে একটু অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা? আমি জানি, এর বিপক্ষেও যুক্তি আসে, বাংলাদেশর সার্বিক অবস্থা, চাকরীর বাজার মন্দা, সব মিলিয়ে দেশে ভাল কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্যে সুখ কিনতে এসে সারা জীবনেও সুখের খোঁজ পাচ্ছিনা আমরা প্রবাসীরা। বিশেষ করে, আমাদের দেশে যারা মেধাবী শিক্ষিত যুবক আছে তারাও বিদেশ-মুখী হয়ে পড়ছে। এর কারণ একটাই দেশে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকার চাকরী বা কাজ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
সবশেষে একটি কথাই বলব, বিদেশ আসার আগে অবশ্যই আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ বা চাকরী নিয়ে আসতে পারলে ভাল হয়। অথবা যেকোনো বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েয়ে দক্ষতা অর্জন করে বিদেশ আসা উচিত।
Copyright © 2023 বর্ণ টিভি | Design & Developed By: ZamZam Graphics